বেথুলদি
বাড়িতে খোলামেলা কথা বলার উপায় নেই। বাবা খুব রাগি। একটুতেই রেগে যান। তাই সারাদিন বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকা ছাড়া কোনো বিকল্প খুঁজে পাই না। তবে হ্যাঁ, বাবা তো আর সব সময় বাড়িতে থাকেন না। সকালে যখন বাজারে যান কিংবা বিকেলে দুধের বোতল হাতে ঘোষ পাড়ার দিকে, তখন মনে হয় প্রাণে প্রাণ ফিরে এলো। মা’র কাছেই যতো আবদার, এবার পরীক্ষা শেষে দু’সপ্তাহ নানার বাড়ি থাকবো, এই বলে দিলাম। আচ্ছা, এই বলে মাথা নেড়ে মা থেমে যান। কিন্তু মামা এসে বললেন এবার আমরা চাঁইপাড়ার বেথুলদি’র বাড়ি যাবো। হ্যাঁ মামা, যে প্রতিদিন সবজি বিক্রি করতে আসে তার কথা কথা বলছো। ঠিক ধরেছিস। এবার পড়ায় মন দে। চোখের পলকে সময় চলে যায়। পড়া এড়ানো সেই আমি এখন জোহা হলে থাকি। ফাইন আর্টসে এবার ফাইনাল দিবো। এক এক করে এতোগুলা পরীক্ষা শেষ হলো অথচ সেই বেথুলদি’র বাড়ি আজও যাওয়া হলো না। তবে এবার মনে মনে পণ করেছি, যাবোই। নব্বই দশকের শেষের দিকে। ফাইনাল হতে আর মাত্র দু’মাস বাকি। রাতে হলের ডাইনিংয়ে প্লেটটা হাতে করে তাতে একটু লবণ ঘষে নিচ্ছি এমন সময়, ওই শুনেছিস কালকে হল খালি করতে হবে। পুলিশ রেইড দিলো, দুই’শ দুইয়ে দুইটা লোহার রড় আর চারে একটা রামাদ-কুড়াল পেলো। বলিস কি ! হ্যাঁ, তাই তৈরি হয়ে নে। তাহলে পরীক্ষা !, জীবন থাকলে তবেই না পরীক্ষা। সেই রাতেই হল ছাড়লাম। পাশের একটা মেসে খুব কষ্টে পড়া-শুনা করে ফাইনালি পরীক্ষা শেষ করলাম। এখন অফুরন্ত সময় এই ভাবতেই বাড়ি থেকে মেসের ঠিকানায় চিঠি এলো, মাস্টার্স্ শেষ করেছো এবার বিসিএস’র প্রস্তুত্তি নাও। চিঠি পেয়ে তো আমি হতভম্ব। বাবা বলে কি ! কিন্তু খুশির খবর হলো মামা আমার মেসে চলে এসেছে। ওই যে বেথুলদি’র বাড়ি যেতে হবে। মামা, আজ রাতটা থেকে তবে কাল ওখানে রওনা দিলেই হবে। আজ রাতে তোমার কাছে তার অনেক গল্প শুনবো। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বেথুলদি’র বয়স পঁচাশির কোঠায়। অথচ এতো বছর জীবনে কথনো নাকি ভাত মুখে তুলেননি। তিন বেলা রুটি খেয়ে দিন কাটান। আর সবজি বেচে যা আয় হয় তা নাকি অসহায়দের মাঝে বিলিয়ে দেন। কিন্তু এর রহস্য কি মামা ? না, ডাক্তারও ভাতের রহস্য ভেদ করতে পারেনি। বেথুলদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাদের আক্রমণে আহতদের সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলো। তাই এমন বীর সৈনিকের সাথে সাক্ষাৎ করা একটা আনন্দের ব্যপার। এখন ঘুমিয়ে পড়। সকালে পেপার ওয়ালা ডাকলো, পেপার হাতে নিতেই মাথাটা কেমন ঘুরে গেলো..মুক্তিযুদ্ধের সাহসী বীর বেথুলদি আর নেই..। পরীক্ষা শেষে ভ্রমণ স্বপ্ন আমাদের অপূর্ণই থেকে গেলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন