এটা বদলে দাও প্রভু ....
কৌশিকের ভেতর সবসময় একটা নদী বয়ে যায় নানান শব্দে। ওই নদী থেকে নানা শব্দ উঠে আসে। কুলকুল শব্দটা তার প্রিয় হলেও পিউয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর কয়েকটা মাসই মাত্র কৌশিক নিজের প্রিয় শব্দ শুনতে পেয়েছে! ব্যস্!তারপর এই দীর্ঘদিন, এই দীর্ঘ সাতটা বছর নদী তার গতিপথ বদলেছে, তারতম্য ঘটেছে শব্দের। শব্দের তারতম্য ঘটার সঙ্গে সঙ্গে পিপাসার্ত হয়েছে সে, ক্রমাগত বেড়েই গ্যাছে তার পিপাসা। পিপাসায় ক্লান্ত হয়ে নৌকো বয়েছে সে নদীতে, জল ছুঁয়ে দেখেছে,অদ্ভুত ভাবে তেতো লেগেছে তার, ঠিক যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে ওঠার পর যে অনুভূতি হয়। কি আশ্চর্য! নদীর পুরো জলই কি তবে একসময় তেতো হয়ে যায়? কৌশিকের ভেতর আজকাল একটা বাগানও বেড়ে চলেছে অতি দ্রুত গতিতে। যেখানে আছে গাছ, সবুজ ঘাস, যেখানে পাখি ডাকে, কোকিলের কুহুতান তাকে মুগ্ধ করে। সে বুকের ভিতর থেকে সারা বাগানকে শুনিয়ে যেন বলে ওঠে, "আমি ভালবাসি, আমি প্রেমিক, আমি বাঁচতে চাই। আমাকে তুমি মেরো না। কোনো প্রেমিককে খুন করতে কি তোমার হাত কাঁপবে না প্রভু? কোনো প্রেমিককে খুন করা বীভৎসতম কাজ। তবে আমার শরীরে বড় জ্বালা। আমি কষ্ট পাই। প্রতিরাত্রে আমাকে একটা রক্ত মাংসের শরীরের কাছে নুব্জ হয়ে যেতে হয়। আমি কৌশিক সেন, আমি বড় অফিসার,আমার তাঁবে আছে আছে দুশো লোক। সবাই আমাকে ভয় করে, মান্য করে, অফিসে আমার কথাই শেষ কথা। কিন্তু আমি অসহায়, অতৃপ্ত ! আহ্! ঈশ্বর, আমি তৃপ্তি চাই। আকণ্ঠ জলপানে পরিতৃপ্ত হতে হতে চাই...একটা শরীর...শুধুমাত্র রক্তমাংসের শরীর ..." কৌশিক এভাবেই সেই বাগানে পায়চারি করতে করতে একটা ঝরণার সন্ধান পেয়ে গেছে মিষ্টি জলের কুলকুল ঝরণা। তার নিজের স্টেনো সুতপা মুখার্জিকে সেই বাগানে আনতে পেরেছে।
কৌশিক লাইট না জ্বেলেই মশারি তুলে খাট থেকে নেমে খুব ধীরে, অন্ধকারে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে সামনের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। চতুর্দিক গভীর অন্ধকারে ডোবা হলেও অন্ধকারের নিজস্ব একটা জ্যোতি আছে। সেই জ্যোতিতে বাড়িঘর, গাছপালা অদ্ভুত তেলচিটে ধরণের দ্যাখাচ্ছে। আকাশে মনমরা চাঁদের দুঃখী কিরণে চারপাশ বড় বিষণ্ণ। প্রতিদিন পূর্ণিমা হলে তার মতো মানুষের অনেক কষ্ট কমে যায়। ছাদভাসা পূর্ণিমায় উদোম শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়া যায় অতি নিশ্চিন্তে । আর তা হয়না বলে প্রতিটি রাত একটি শরীরী তুফান আরেকটি প্রস্তর শরীরের ওপর আছড়ে পড়ে চৌচির হয়ে যায়। শুধু নিজেই নিষ্ফলা আক্রোশে ভাঙ্গাচোরা সেতুতে এসে ঠেকে। তখন বিগ অফিসার কৌশিক সেন দুমড়ে মুচড়ে একটা নির্বিষ সরীসৃপের মতো পাশ ফেরে। পরের ছোবলেও বিষ ঢেলে সে পিউকে আলোড়িত করতে পারে না। দিনের পর দিন এই একই খেলায় বিরক্ত হতে হতে সুতপাই ঢেউ তুলেছে তার জীবনে।
কৌশিক সামনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। জোনাকির মতো এক চিলতে আলো ওঠানামা করতে থাকে। দুরে পুলিশের হুইসল শোনা যায়। একটা ট্রাক অন্ধকারের বুকে পা ফেলে পেরিয়ে যেতেই কৌশিক পিছন ঘুরে তাকায়। সামনে তার বেডরুমের ভেতরটা একদম নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। ওই অন্ধকারে খাটের ওপর অঘোর ঘুমে নিশ্চল তার স্ত্রী পিউ।
কৌশিক জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরোটা দুরে ছুঁড়ে দিয়ে ব্যালকনি থেকে অন্ধকার ঘরে এসে ঢুকে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দেয়। মশারির ধারে এসে ঘুমন্ত পিউয়ের মুখটা লক্ষ্য করে। লক্ষ্য করতে করতে ভাবতে চেষ্টা করে পিউ সুতপা হয়ে উঠেছে। তার সবকিছু পাল্টে যাচ্ছে। এমনকি সুতপার শরীরের গন্ধ পর্যন্ত পিউয়ের শরীর থেকে উঠে আসছে। কৌশিক ঘেমে ওঠে উত্তেজনায়, জিভ লালায় জড়িয়ে আসছে। মশারি তুলে বিছানায় উঠে বসে। পিউকে দুহাতে নাড়া দিয়ে ডাকে। পিউ চ্যাটচ্যাটে ঘুম জড়ানো চোখে জিজ্ঞেস করে..."কি? ..কি বলছো? তুমি এখনো ঘুমোওনি?"
কৌশিক বলে ...তোমাকে একটা কথা বলবো ভেবে ঘুমোতে পারিনি। "
"কি পাগল লোক রে বাবা! কি বলবে, বলো এতো রাত্রে ?"
"তোমাকে আজ থেকে সুতপা বলে ডাকবো, রাজি তো? "
"কি যে পাগলামি করো! না ঘুমিয়ে জেগে জেগে সুতপা নামের কোনো মেয়ের স্বপ্ন দেখেছিলে, না উপন্যাস পড়ছিলে?"
"না তা নয়। তবে তুমি কথা দাও তুমি সুতপা হবে?তুমি সুতপা হয়ে উঠবে? চলো, আজ আর আমরা এই খাটে শোবো না। মাটিতে বিছানা পাতো। এই খাটে আমার শরীর জ্বালা করে। প্লিজ, আমার জন্য একটু কষ্ট করো। প্লিজ সু......" কৌশিক পিউয়ের হাত দুটো ধরে খুব কাতর গলায় বলে। পিউ কোনো উত্তর না দিয়ে পাশ ফিরে শোয়। কৌশিক ঝুঁকে তার মুখের কাছে মুখ আনতেই পিউ তাকে জাপ্টে ধরে পাশে শুইয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলে ..."আমি তোমার পিউ, অন্য সবাই খারাপ মেয়ে...এসো ..." পিউ তাকে জড়িয়ে ধরতেই বৃদ্ধ সরীসৃপের মতো কুন্ডলি পাকিয়ে গুটিয়ে যায় কৌশিক পিউয়ের দুহাতের মধ্যে। নাহ্! এবারো হলো না! পরের ছোবলে দেখতে হবে সে সফল হচ্ছে কিনা। ঘুম ঘুম অবশ লাগে নিজেকে কৌশিকের। ঘুমে তলিয়ে যাবার আগে বিড়বিড় করে, " এটা বদলে দাও প্রভু!.....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন