শনিবার, ১ মে, ২০২১

কাজল সেন-এর ঝুরোগল্প


মহাপ্রস্থানের পথে

মুম্বাইয়ের ক্যান্সার হাসপাতাল থেকে কেমোথেরাপির পর পিয়াশ্রী যখন বাড়ি ফিরে এলো, তখন তার রূপ যেন ফেটে পড়ছে। যার চোখ তার দিকে যাচ্ছে, মুগ্ধ হয়ে তারা তাকিয়েই থাকছে। যেমন সুন্দর মুখের গড়ন, তেমন আকর্ষণীয় শরীরের গঠন। আর গায়ের রঙ তেমনি ঝকঝকে ফর্সা উজ্জ্বল। পিয়াশ্রী যে অপরূপা সুন্দরী, তা ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার আগে সবাই দেখেছে। কিন্তু  মারণরোগের শিকার হবার পরও যে তার রূপ-সৌন্দর্য অটুট থাকতে পারে, তা  কেউ ভাবতেই পারেনি। শুধু একটাই বিপত্তি ঘটেছে। আগে মাথার চুলের ঢল নামত তার পিঠ বেয়ে, এখন তা আর নেই, বরং সব চুল ঝরে পড়েছে, দেখলে বৌদ্ধ ভিক্ষুণী বলে মনে হচ্ছে। মুখে অদ্ভুত এক শান্ত উজ্জ্বল আলো খেলা করছে যেন।

কিছুদিনের মধ্যেই আবার ফিরে যেতে হবে হাসপাতালে। হাতে সময় খুব কম। পিয়াশ্রী তাই মনে মনে সাজিয়ে নিল কী কী কাজ করে যেতে হবে ফিরে যাবার আগে। দ্বিতীয়বার আর আসা সম্ভব নাও হতে পারে! প্রথমেই সে দেখা করতে  গেল ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের অধ্যাপক . ত্রিপাঠীর সঙ্গে। তিনি তার জীবনে এক আশ্চর্য আলোকস্তম্ভ। বাংলা সাহিত্যের গভীর ভাবনা অমল আনন্দের সঙ্গে নিবিড় পরিচিতি ঘটেছিল তাঁরই জন্য। পিয়াশ্রী দেখা করে বলল, স্যার, আর হয়তো দেখা হবে না, কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্তটিতেও আমার মনে পড়বে বৈষ্ণব পদাবলী, রবীন্দ্রনাথেরগোরা’, শরৎচন্দ্রেরশ্রীকান্ত’, মানিকেরপুতুলনাচের ইতিকথা।

দেখা করল অভিনন্দনের সঙ্গে। দেখা করা খুব জরুরি ছিল। তার ভালোবাসার পুরুষ অভিনন্দন। একেবারেই ভেঙে পড়েছে। পিয়াশ্রী তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেও কাঁদল। আসলে সান্ত্বনা তো নেই। সারাটা জীবন পরস্পরকে ভালোবাসার অঙ্গীকার ছিল তাদের। পাশাপাশি থাকার কথা ছিল। কিন্তু সম্ভব হলো না। পিয়াশ্রীকে যে কোনোদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। যেতেই হবে। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা হয়তো যাওয়াটা কিছুদিন পিছিয়ে দিতে পারে। তারপর অভিনন্দন আর পিয়াশ্রীকে খুঁজে পাবে না। থেকে যাবে শুধু স্মৃতিতে। পিয়াশ্রী বলল, আমি থাকব না, তুই থাকবি, ভালো থাকার চেষ্টা করবি, যতটা ভালো থাকা যায়।

আরও কিছু কাজ ছিল পিয়াশ্রীর। একে একে কাজগুলো সেরে নিল। শরীরটা আবার খারাপ হতে শুরু করেছে। তাই হবার কথা। শরীরের এমন জটিল জায়গায় রোগ বাসা বেঁধেছে, ডাক্তারবাবুরা অপারেশন করার ঝুঁকি নিতে রাজী হচ্ছেন না। হয়তো শেষ চেষ্টা হিসেবে অপারেশন করা হবে, কিন্তু মরতে তো হবেই!

মুম্বাই হাসপাতালে ফিরে যাবার দিন কয়েক আগে পিয়াশ্রী দেখা করতে গেল রামনাথের সঙ্গে। এই দেখা করাটা আরও জরুরি ছিল। সেই রামনাথ, যার পরিচিতি একটা গুন্ডা লুচ্চা লম্পট হিসেবে। সেই রামনাথ, যে একদিন নির্জন রাস্তা থেকে পিয়াশ্রীকে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে একটা ঝোপের পেছনে ধর্ষণ করেছিল।

পিয়াশ্রীকে দেখে হকচকিয়ে গেল রামনাথ। পিয়াশ্রী হেসে বলল, তুমি একদিন আমাকে উঠিয়ে এনেছিলে। আজ আমি নিজেই এসেছি। আমার ক্যান্সার। খুব  তাড়াতাড়িই মরে যাব। আমাকে কি তোমার আর প্রয়োজন আছে?

1 টি মন্তব্য: