ভ্রান্তি
অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম, সুবিনয়কে একবার দেখতে যাব। শুনেছি অলকা মারা যাওয়ার পর থেকে ও আর অলকানন্দা-তে থাকে না। কানাডাবাসী মেয়ে বহুবার নিয়ে যেতে চাইলেও ওর সেই এক গোঁ এই উত্তরপাড়া ছেড়ে ও কোথাও যাবেনা। অলকার বড় সাধের সাজানো বাড়ি থেকে যেদিন অলকা একমাথা সিঁদুর নিয়ে একক যাত্রা করেছিল, সেদিন ওদের আর এক বন্ধু সুধাকর জোর করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল ওকে। মহানির্বাণ মঠে অলকার পারলৌকিক কাজ সেরে গোপনে ঠিক করে রাখা ভাড়াবাড়িতে উঠে যায় সুবিনয়।
উত্তরপাড়ার এই দোতলা বাড়িটার একতলার দুটো ঘরে এখন সংসার সুবিনয়ের। গত পাঁচ বছরে দু’বার এসেছে ওর মেয়ে সায়নী। মেয়ে তো বটেই ওর স্বামী শোভনও বারবার অনুরোধ করেছে শ্বশুরমশাইকে ওদের সঙ্গে কানাড়ায় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবার জন্য। টলানো যায়নি সুবিনয়কে।
এই পাড়ায় সুবিনয়কে নিয়ে একটা গুঞ্জন আছে। প্রতি রবিবার সকাল হতে না হতেই একটা সাইড ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কোথায় যায় সে ? স্টেশনে দেখেছে কেউ, কেউ দেখেছে টিকিট কাটতে, ট্রেনে উঠতেও দেখেছে দু’চারজন। সুধাকরের সঙ্গে একদিন গড়িয়াহাটে দেখা হলে ও-ই বলেছে আমায় এসব কথা। আমি ওর খোঁজখবর নেবার অছিলায় ফোনও করেছি বার কয়েক। হ্যাঁ আর না-তে উত্তর সেরেছে। তারপর যা হয় ওদিক থেকে আগ্রহের অভাব আমাকেও ওর ব্যাপারে নিস্পৃহ করে তোলে।
গত পরশু সুধাকর ফোন করে জানাল, রাস্তায় পড়ে গিয়ে পা ভেঙে বিপদ ঘটিয়েছে সুবিনয়। পাড়া-প্রতিবেশীরা হাসপাতালে নিয়ে যায়। এখন প্লাস্টার নিয়ে বাড়িতে পড়ে আছে। সামনের রোববার ওকে দেখতে যাব ঠিক করেই ফেললাম।
সুবিনয়ের জন্য আমার গিন্নি টিফিন ক্যারিয়ার ভরতি করে পোলাও, চিকেন, চাটনি, পায়েস করে দিয়েছে। এই বয়সে আর ট্রেন ধরার ঝক্কি পোয়াতে ইচ্ছে হ’ল না। একটা উবের ধরে বেরিয়ে পড়লাম।
বাড়িটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হ’ল না। ঢুকে গেলাম সহজেই ; কেননা দরজাটা ছিল হাট করে খোলা। ওপরে থাকেন বাড়িওয়ালা—বৃদ্ধ দম্পতি, খুব দরকার ছাড়া নামেন না। পরদাটা সরিয়ে ঢুকে থমকে গেলাম। অল্পবয়সি এক আধুনিকা সুবিনয়ের মাথাটা কোলের ওপর নিয়ে মাথায় মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পরিচ্ছন্ন জামাকাপড়, ঘরটাও বেশ টিপটপ করে সাজানো-গোছানো। মনটা ঘৃণা আর বিরক্তিতে ভরে গেল। সুবিনয় ডাক দিল—আয় আয় অণুতোষ। মেয়েটি তাড়তাড়ি উঠে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল—বসুন। আপনারা কথা বলুন, আমি চা আনছি।
সে বেরিয়ে যেতেই বললাম, চা কেন তোর ঘরে জল খেতেও রুচি হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত তোর এত অবনতি ! সুবিনয়ের মুখে লজ্জা বা অনুতাপের চিহ্নও নেই। সে হেসে বলল, নারে যা ভাবছিস তা নয়। ও আমারই সন্তান রেবেকা। তোর মনে আছে শ্যালির কথা? ওকে জীবনে পাইনি। আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন করতে ওর বাবা ট্রান্সফার নিয়ে চলে যান। সামান্য অসতর্কতায় রেবেকা তখন এসে গিয়েছে ওর শরীরে। শ্যালি আর বিয়ে করেনি। এই কন্যার কথা শ্যালি জানিয়েছিল—নিরন্তর যোগাযোগ রেখেছিল। অলকাকে আমি ফাঁকি দিইনি। সব দায়িত্ব, কর্তব্য পালন করেছি। গাড়ি-বাড়ি-সন্তান সব দিয়েছি। শ্যালি ক্যান্সারে মারা গিয়েছে পাঁচবছর আগে। রেবেকা সব জানে। সম্মানসহ ওকে জীবনে স্থিতু করে দিয়ে আমার ছুটি।
নিন কাকু। সামনে ট্রে ভরতি লুচি তরকারি আর মিষ্টি হাতে রেবেকা। আমার অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এল—দাও মা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন