কাগজিলেবু কমলালেবু
কোম্পানিতে চাকরি করার সূত্রে বাবা যে কোম্পানির কোয়ার্টারসটা পেয়েছিলেন, সেখানে থাকতেই জন্ম হয়েছিল রুমানির। সে আজ কবেকার কথা! কিন্তু জন্মসময়ের কথা কারই বা মনে থাকে, রুমানিরও মনে নেই, বরং মনে হয় সেটা বুঝি অনেক অনেক আগের জন্মের কথা। আর তারপর যে তার আরও কতবার জন্ম হয়েছে!
রুমানির মনে পড়ে, তাদের সেই কোয়ার্টাসের উঠোনে একটা খুব ঝাঁকড়া কাগজিলেবুর গাছ ছিল। যখন সেই লেবুগুলো পূর্ণযৌবনা হয়ে উঠত, ভেতরটা রসে টইটম্বুর ভরে উঠত, তখন শুধু নিজেদের ঘরেই নয়, বরং পাড়া প্রতিবেশীদের ঘরেও পৌঁছে যেত তার যুবতী শরীরের সুবাস। রুমানির মা বাবা ডেকে ডেকে কাগজিলেবু বিলি করতেন সবাইকে। রুমানির মনটাও তখন এক অদ্ভুত রোমাঞ্চে শিহরিত হয়ে উঠত। সে অনুভব করত, তার এই নরম নম্র ছোট্ট শরীরটাও এভাবেই একদিন কাগজিলেবুর মতোই যুবতী হয়ে উঠবে। রসে রসে ভরপুর হয়ে উঠবে তার মনের ও শরীরের প্রতিটি আনাচ কানাচ।
অথচ রুমানির মন খুব বিষণ্ন হয়ে যেত যখনই তার দৃষ্টি চলে যেত সেই কাগজিলেবু গাছের একটু দূরেই দাঁড়িয়ে থাকা কমলালেবুর গাছের দিকে। সবাই খুব অবাক হতো এই শহরের মাটিতে কমলালেবুর গাছ দেখে। এখানে তো এই গাছ জন্মানোর কথা নয়! জন্মালেও বেঁচে থাকার কথা নয়! তাহলে! রুমানির এসব কথা শুনতে ভালো লাগত না। আহাঃ, জন্মেছে যখন, তখন থাক না বেঁচে। এমন সব হাবভাব করে, যেন মরে গেলেই সবাই খুশি হতো! গাছটার জন্য খুব মায়া হতো তার। বিষণ্নতা জাগত।
কিন্তু মজার ব্যাপার, সেই কমলালেবুর গাছে কখনও কেউ কমলালেবু দেখেনি। রুমানি ভেবে কূল কিনারা পেত না, কেন এমন হলো! কাগজিলেবুর গাছটা বছরের পর পর অসংখ্য অজস্র লেবু প্রসব করে চলেছে, অথচ কমলালেবুর গাছে একটাও কমলালেবু জন্মালো না! কেন? তার এত অভিমান কিসের? প্রশ্নটা একদিন রুমানি করেছিল তাদের পাশের কোয়ার্টাসের ঝুমাবৌদির কাছে। ঝুমাবৌদি বলেছিল, ওমা! তুই জানিস না বুঝি! আরে ওটা তো বাঁজাগাছ। রুমানি বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা। ঝুমাবৌদি বুঝিয়েছিল, এই দেখ না, বিয়ের পর আমার পেট থেকে দু’দুটো বাচ্চা জন্মেছে। আর তোদের ডানদিকে ঐ যে আদিত্য মুখার্জি থাকে, আমার অনেক আগে বিয়ে করেছে, কিন্তু ওর বৌয়ের আজও পেট থেকে কোনো বাচ্চা জন্মায়নি। আসলে ঐ মুখার্জির বৌটা হচ্ছে বাঁজা। বুঝলি?
রুমানির এতকিছু তলিয়ে বোঝার তখনও ঠিক বয়স হয়নি। ঝুমাবৌদির কথাটাও তার ভালো লাগেনি। সে একটা সদুত্তর খোঁজ করছিল। শেষে রুমানি তার মা’কেই একদিন প্রশ্নটা করে বসল। মা প্রথমাটা হকচকিয়ে গেলেন প্রশ্ন শুনে। উত্তরটা তাঁরও ঠিক জানা নেই। তবু মেয়ের মন রাখতে বললেন, ওটা তো পুরুষ কমলালেবুর গাছ। পুরুষের কখনও বাচ্চা হয় নাকি? মেয়েদের হয়।
মায়ের সাদামাটা কথার মধ্যে কী যে ছিল, রুমানি আপাদমস্তক কেঁপে উঠেছিল। দৌড়ে গেছিল কমলালেবুগাছের কাছে। গাছের পাতা স্পর্শ করে বলেছিল, তুমি নিজেকে একা মনে কোরো না প্লিজ! আমি তো আছি!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন