মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
সম্পাদকের নিবেদন
সম্পাদকের নিবেদন
‘The Generation of Animals’ গ্রন্থে অ্যারিস্টোটল (384 BC — 322 BC) বলেন যে বুদ্ধিহীনতাই নারীত্বের লক্ষণ। অসামর্থ্যই নারীত্বের পরিচায়ক। তাই নারী পুরুষের সমকক্ষ নয়, পুরুষের তুলনায় হীন। প্লেটোর (427 BC — 348 BC) দর্শনেও নারী জড় দ্রব্যের অন্তর্গত।
‘Emile’ গ্রন্থে রুশো (1712 — 1778) লেখেন, “To be pleasing in his sight, to win his respect and love, to train him in childhood, to tend him in manhood, to counsel and console, to make his life pleasant and happy, these are the duties of woman for all time and this is what she should be taught while she is young” — রুশোর এই মন্তব্য মেরী ওয়ালস্টোনক্রাফটকে (1759 — 1797) কতো তীব্রভাবে আঘাত করে। ‘A Vindication of the Rights of Women’ (1792) গ্রন্থে তিনি দ্বিধাহীনভাবে উগরে দিয়েছেন তাঁর যাবতীয় ক্ষোভ।
যেমন আমরা দেখেছি, সিমন দ্য ব্যুভোয়ার 'The Second Sex' (1949) গ্রন্থের দুটি তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি —
১. One is not born, but rather becomes, a woman.
২. He is the subject, he is the absolute — she is the other.
এনলাইটেনমেন্ট যুগের ব্রিটিশ নারী, মননশীল চর্চায় নিষ্ক্রিয় বিষয়স্বরূপ নয়। এইরকম কয়েকজন মেরী ওয়ালস্টোনক্রাফট্, ক্যাথারিন ম্যাকলে প্রমুখ মননশীল চর্চার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত।
ফরাসিদেশে Francoise de Graffingy, Marie Jeanne Riccoboni, Isabella de Charriera জ্ঞানতাত্ত্বিক তথা লেখক হিসেবে গুরুত্ব সহকারে গৃহীত।
যেমন বাংলাভাষার শক্তিশালী লেখক হিসেবে কবিতা সিংহ, নবনীতা দেবসেন, আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী প্রমুখ।
নারীবাদী যে কোনোরকম মেরুকরণের বিরোধী। তাঁদের মতে বিভিন্ন বিষয় যদি নারীবাদী জ্ঞানতত্ত্বে উপস্থিত থাকে, তাহলে তা মূলস্রোতের জ্ঞানতত্ত্বেও উপস্থিত থাকবে। নারীবাদী চিন্তকেরা কখনোই পুরুষতান্ত্রিক মূলস্রোতের তত্ত্বকে নারীকেন্দ্রিক দর্শন দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে চাননি, তাঁরা জ্ঞানতত্ত্বকে কেবল পরিবর্তন করতে চান। নারীবাদী চিন্তন বস্তুত জীবনের সম্পূর্ণতাকে উপলব্ধি করতে চায় — তাতে পুরুষের-জীবনও তাদের আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে।
নারীবাদী-দর্শনের ব্যাপ্তি বিশাল। এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় শুধু ছুঁয়ে দেখা হচ্ছে মাত্র।
এখন নারীর প্রতি হিংসাত্মক আচরণ বা তার অবদমনের বিষয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে। যেমন সমস্ত মানব জাতির মধ্যে নারীর উপরেই কেন হিংসার আস্ফালন বেশি ঘটে। আবার পারিবারিক হিংসা শিশু, নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা সকলের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়। এক্ষেত্রে যেহেতু নারীর কথা বলছি, নারীর যাপিত অভিজ্ঞতা থেকে যে সমস্যা বিশেষভাবে উঠে আসে তা হল — কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গসাম্যাবস্থা বিঘ্নিত হয়। সমাজে নারীর অমর্যাদা, অবদমন ও অবহেলার ঘটনা বারংবার ঘটেই চলেছে এবং চলছে।
মেয়েদের তাদের নিজেদের অবস্থান, জীবন অভিজ্ঞতা, ইচ্ছা, চাহিদা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। জ্ঞান প্রক্রিয়া থেকে যাতে তারা বঞ্চিত না হয়, সে বিষয়ে তাদের সজাগ হতে হবে। নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও, বিশ্বজুড়ে অসংখ্য নারী সেই অধিকার অর্জন করেছেন এবং করে চলেছেন।
স্কুল, কলেজ, কর্মক্ষেত্র, পথঘাট — সর্বত্র যথেষ্ট নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে হবে। সমস্ত সামাজিক পৈশাচিক ব্যাধির মূল থেকে অপসরণ ছাড়া, একটা সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবীর কল্পনা অবান্তর। অপরাধীর কোনো লিঙ্গ হয় না। তারা মানবজাতির কলঙ্ক। অর্থাৎ ‘মানবিক’ সিদ্ধান্তে সর্বোপরি বিশেষ জোর দিতে হবে।
সম্প্রতি কলকাতা সহ বেশ কিছু জায়গায় খুন-ধর্ষণের ঘটনায় অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। বিপন্ন এই সময়। অপরাধীদের কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তির আবেদনে পুরো দেশ তথা বিশ্বজুড়ে জনসাধারণ প্রতিবাদ-আন্দোলনে সামিল হয়েছে। We want Justice.
‘রঙিন ক্যানভাস’-এর উৎসব সংখ্যা প্রকাশিত হল। সকল লেখক এবং পাঠককে শারদ শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন রইল। ভালো থাকুন সকলে।
রোশনি ইসলাম
সোনালি বেগম
ঋতম্ মুখোপাধ্যায়-এর ধারাবাহিক গদ্য : "কবিতার বাতায়ন"
আকাশমুখী আঙুলগুলি অনুপনীত
‘The voice of the poet will reveal to us by the inspired rhythmic word the God who is the self of all things and beings, the life of the universe, the divinity of man’. (The Future Poetry, Sri Aurobindo)
সার্ধশতজন্মবর্ষে দাঁড়িয়ে বিশ্ববাসীর চোখে তিনি ঋষি অরবিন্দ (১৮৭২-১৯৫০)। কিন্তু যোগী ও দার্শনিক এই পরিচয়ের বহু আগে থেকেই তাঁর কবি ও রাজনীতিক সত্তা ভারতের ইতিহাস ভুলে যেতে পারে না। তিনি নিজেই জানিয়েছেন : ‘যোগ করা ও পণ্ডিচেরীতে আসার আগে দর্শনের বিষয় থোড়াই জানতাম – ছিলাম শুধু কবি ও রাজনীতিক, দার্শনিক নয়’। (‘নিজের কথা’, পশুপতি ভট্টাচার্যকৃত অনুবাদ) ইংরেজি ভাষায় অসামান্য দক্ষতার পাশাপাশি বাংলা, ফরাসি, ল্যাটিন, তামিল ইত্যাদি বহুভাষায় অধিকার ছিল শ্রী অরবিন্দ ঘোষের। জন্মসূত্রে বাঙালি হয়েও ইংরেজিয়ানার শিক্ষা পেয়েছিলেন পিতার আগ্রহেই। উচ্চশিক্ষার্থে চোদ্দ বছর বিদেশে থাকা এবং ফিরে আসা সিভিল সারভেন্ট হয়ে। তারপর পরাধীন ভারতে বিপ্লবী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া, কারাবাস এবং ক্রমশ বিপ্লবী থেকে যোগী হয়ে ওঠা – এই যাত্রাপথে কবিতা কখনওই তাঁর সঙ্গ ছাড়েনি। মাত্র সাতবছর বয়সে দার্জিলিং কনভেন্টে পড়ার সময় তাঁর মধ্যে যে কবিপ্রতিভার স্ফুরণ ঘটে, তাকেই লালন করেছেন তিনি। ছোট ও দীর্ঘ কবিতা, অসংখ্য দেশীয় সাহিত্যকর্মের ইংরেজি অনুবাদ এবং মননশীল প্রবন্ধ, পত্রাবলী, ধর্মদর্শন তাঁর বিস্তীর্ণ রচনাবলীতে ছড়িয়ে রয়েছে। মূলত ইংরেজিতে লেখালেখি করলেও মাতৃভাষা বাংলাতেও তাঁর একগুচ্ছ রচনার সংকলন ইদানীং দুই মলাটে সহজলভ্য। অরবিন্দের কবিতায় যেমন পুরাণের নবনির্মাণ ঘটেছে, তেমনই ছোট কবিতার গীতলতা আমাদের মনোহরণ করে। যাঁরা তাঁর দীর্ঘ কবিতা এবং আখ্যান কবিতাগুলির দার্শনিক তত্ত্বকে দুরূহ ভাবেন, তাঁরা এই ছোট লিরিকগুলি পাঠে অরবিন্দের কাব্যদর্শনের মর্মবাণীটুকু সহজেই অনুভব করতে পারেন। কারণ কবি নিজেও বিশ্বাস করতেন : ‘Only brief work intense, lyrical in spirit’। তদুপরি বিশ্বকবিতা পাঠের অভিঘাতে তাঁর কবিতায় স্বদেশ ও বিদেশের কাব্যদর্শনের যে সমীকরণ তৈরি হয়েছিল, তাতে ভারতীয় ইংরেজি কবিতালোক সমৃদ্ধ হয়েছে। যদিও তাঁর অধিকাংশ কবিতা পরিণামে এক দিব্যানুভবে পৌঁছতে চেয়েছে, তবু প্রেম বা কামকে কোথাও অবজ্ঞা করেননি তিনি। তাই তাঁর চিত্রাঙ্গদা, পুররবা, উলূপী কিংবা রুরু প্রেমাস্পদকে নিবিড়ভাবে পেতে চায় আত্মত্যাগের মূল্যে। আর কবির বিজয়-বৈজয়ন্তী ‘সাবিত্রী’ হয়ে ওঠে কালো পেরিয়ে আলোর সাধনা, যা আসলে অমৃতের আস্বাদ দেয় ‘Love is the divine power by which all can change’।
(দুই)
শ্রীঅরবিন্দের ‘কালেক্টেড পোয়েমস্’ খুলে বসলে আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর একাধিক ছোট কবিতার স্বাদ নিতে পারি। ধারাবাহিক ভাবে না পড়লেও ক্ষতি নেই কোনো। তাঁর প্রেম-প্রকৃতির অভিমুখ আধ্যাত্মিক বলয়ের দিকে যাত্রা করলেও কবিত্বের অভাব সেখানে বিন্দুমাত্র নেই। কোথাও বা বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদনের মতো কবিদের নিয়েও কবিতা লিখেছেন তিনি। তবে অনুবাদের দর্পণে সেসব কবিতাপাঠ ভিন্ন আস্বাদ দিতে পারে আমাদের। কারণ একালের তত্ত্ববিশ্বে অনুবাদ নিছক ভাষান্তর নয়, পুনর্লিখন। তন্নিষ্ঠ পাঠকের মতো অনুবাদক মূল ভাষায় লেখা কবিতার নিহিত সংকেতের পাঠোদ্ধ্বার করে তাকে পুনর্বিন্যস্ত করেন আরেক ভাষার কবিতায়। তাই নিবিড় পাঠ ও পুনর্লিখনের এই প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠতে থাকে নতুন আরেকটি কবিতা, যা মূল কবিতার নেহাত ছায়ামাত্র নয় আরেকটি ‘অনন্য পাঠকৃতি’, অক্টাভিও পাজের ভাষায় ‘each translation is a creation and thus constitutes a unique text.’। অরবিন্দর কবিতা নানা সময়ে অনূদিত হয়েছে বারংবার। নলিনীকান্ত গুপ্ত ‘সাবিত্রী’ যেমন একটি স্মরণীয় অনুবাদ, তবে ভাষায় রাবীন্দ্রিক বাক্রীতির ছায়া সেখানে। তাই একবিংশ শতকে মনস্বী কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত যখন একসঙ্গে দশটি কবিতা অনুবাদ করে আমাদের সামনে এনে হাজির করেন, তাঁর পুনর্লিখনের নিজস্ব মুদ্রায় আমরা নন্দিত হই। আধুনিক মনের উপযোগী এই অনুবাদের ভাব ও ভাষাশৈলী মূলকে ছুঁয়েও মুক্তির স্পর্শমুখর। অনুবাদের শুরুতেই দশটি কবিতা অনুবাদের কৈফিয়ৎ হিসেবে কবি-অনুবাদক যা জানান, তা উদ্ধৃতিযোগ্য :
শ্রীঅরবিন্দের দশটি কবিতা ইংরেজি থেকে বাংলাভাষায় আনতে চেষ্টা করেছি। অনুবাদ বিষয়ে তাঁর সুসংগত দ্বিধাদ্বন্দ্ব সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। আমার জবাবদিহি শুধু এই, কবিতাগুলির মর্জিমুহূর্তের দিকেই আমি দৃষ্টি রেখেছি, অক্ষের পরিকাঠামোর প্রতি নয়। এই কবিতাগুলি পড়লে হয়তো উপলব্ধি করা সম্ভব হবে, লিখতে-লিখতেই তিনি জীবমুক্তির স্বাদ পেয়েছিলেন। কবিতার মাধ্যমেই তিনি যোগী হয়ে উঠেছেন, এবং সেই যোগ জীবন্ত। এই লিরিকগুচ্ছে তাঁর পরবর্তী অনেক দার্শনিক আধ্যাত্মিক বীক্ষার পূর্বাঙ্কুর উদ্যত হয়ে আছে। কিন্তু আমার কাছ তাঁর মহিমা প্রধানত কবিতার, এটুকুই আমার বলার কথা।
(শ্রীঅরবিন্দের কবিতা, সন্ধিৎসা, ফেব্রুয়ারি ২০১৬)
মূলের নামোল্লেখসহ মোট দশটি কবিতা অনুবাদ করেছেন অলোকরঞ্জন, কবিতাগুলি ১৮৯৫-১৯০৮ কালপর্বে রচিত; তখন এদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তুঙ্গে। কবিতাগুলি হলো : Invitation (আমন্ত্রণ), Reminiscence (স্মৃতিচর্যা), Immortal Love (প্রণয় অনশ্বর), The sea at night (সাগর, রাত্রি এলে), Evening (সন্ধ্যা), Revelation (উন্মোচন), A Tree (একটি গাছ), Seasons (ঋতুচক্র), Life and Death (জীবন এবং মৃত্যু), God (ঈশ্বর)।
(তিন)
অনুবাদবীক্ষণ বা ট্রান্সলেশন ক্রিটিসিজম কেবল মূলানগত্য নিয়েই ভাবিত হয় না এখন। বরং ভাবতে চায় অনুবাদকর্মটি কতখানি মূলকে ছুঁয়েও স্বতন্ত্র সৃষ্টির মর্যাদা পেয়েছে। অনুবাদ তাই স্রষ্টা ও অনুবাদকের যুগল সম্মিলনে পাঠকের দরবারে পৌঁছে যায়। যদিও পাঠকমুখী নাকি লেখকমুখী হবে সেই অনুবাদ, তা নিয়ে মতভেদ চলে নিরন্তর। অনুবাদকের ভাষার উপযোগী দেশিকরণ নাকি স্রষ্টার ভাষাকে অক্ষুণ্ণ রেখে বিদেশিকরণ ঘটবে, তা একান্তই অনুবাদকের মর্জিনির্ভর। তবে অনুবাদক অলোকরঞ্জন তাঁর অনুবাদে অনুবাদকের শৈলীকে ছুঁয়েও নিজস্ব শৈলীকেই বড় করে তুলেছেন, শব্দচয়নেও নিজের মৌলিক কবিতার মতোই তিনি সৃজনশীল কবি। তাঁর সুবিধে এখানে এই যে, অরবিন্দও ভারতীয় ইংরেজির কবি, তাই ভাষার ভিন্নতা থাকলেও সংস্কৃতির ভিন্নতা নেই। এই অনুবাদগুচ্ছ থেকে কয়েকটি কবিতা এবং কিছু শব্দবন্ধ বেছে নিলেই কবির এই অভিপ্রায় স্পষ্টভাবে দেখানো সম্ভব। ধরা যাক, ‘আমন্ত্রণ’ কবিতাটির কথাই। প্রথম স্তবকেই কবি যেসব বিকল্প শব্দচয়ন করেন, তা যেমন অনুবাদকের নিজস্ব মুদ্রাকে চেনায়, তেমনি অরবিন্দের কবিতার ভাবকেও অস্পষ্ট রাখে না :
With the wind and the weather beating round me
Up to the hill and the moorland I go.
Who will come with me? Who will climb with me?
Wade through the brook and tramp through the snow?
যেহেতু ঝড়বাতাসে আমাকে তাড়িয়ে ঘোরে ফেরে
আমি যাই পাহাড়ের উপরের ব্রহ্মডাঙাটায়।
কে যাবে আমার সঙ্গে? কে হবে আমার সহারোহী?
স্রোত ভেঙে, ছন্নছাড়া যেমন তুষার ঠেলে যায়?
অনুবাদ হিসেবে অবশ্যই মূলানুগত, কিন্তু মুরল্যাণ্ডের বিকল্প ‘ব্রহ্মডাঙা’ কিংবা ‘সহারোহী’ শব্দের চমৎকার প্রয়োগ আমাদের নন্দিত করে। বিশেষত অনুর্বর উঁচু জমির প্রতিশব্দ ব্রহ্মডাঙা আমরা খেয়ালই রাখি না, আর সহযাত্রীর মতোই অনায়াসে তাঁর কলমে এসে যায় সহারোহী। বাকি তিন স্তবক জুড়েও এমন সব অপ্রত্যাশিত বিকল্প শব্দচয়ন লক্ষ করি, যথা : welkin = নভোদেশে, misadventure =দুর্দৈব, wind-swept uplands ascend = বাত্যাবিধূনিত ঊর্ধ্বদেশে, lord of tempest and mountain = প্রভঞ্জন আর পর্বতের রাজরাজেশ্বর, walks at my side = সতীর্থ চরণিক। মূল কবিতাটি যে আধ্যাত্মিক বলয়কে ছুঁতে চায়, এই অনুবাদের ভিতরে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
‘স্মৃতিচর্যা’ কবিতায় আমরা বিকল্প শব্দের চমকের পাশাপাশি অনুবাদকের ব্যাখ্যামূলক সংযোজন লক্ষ করি। winged compeer যেমন হয়েছে ‘ডানাময় বন্ধু’, তেমনি Ocean deep –এর বিকল্প ‘দুরবগাহ সাগর’। তবে ‘It beheld the stars / Born from a thought and knew how being prepares.’-এর অনুবাদে ‘সেই চিন্ময়ীকেই দেখলাম যে-প্রসূতি ভূমিষ্ঠ করে গ্রহতারা, অস্তিত্বের প্রস্তুতি’ পড়লে আমরা ঐ ‘চিন্ময়ী’ যে চিন্তাময়ী সত্তার প্রতিরূপ তা বুঝি, ‘থট’ থেকে এই ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ অলোকসামান্য বলা চলে।
‘প্রণয় অনশ্বর’ কবিতাটিতেও wealth of Nature’s brilliance = ‘নৈসর্গিক অভিরতি’, woman fair = শ্রীমতী, virtuous youth = ‘তারুণ্যের বৈভব’, tender yearning speech =‘কম্প্রকাঙ্ক্ষিত সংলাপ’, swift compassion and deliberate truth = ‘তূর্ণ মমতা ঋত মনস্বিতা’ এসব শব্দবন্ধ অলোকরঞ্জনীয় বলে চিনে নিতে অসুবিধে হয় না। প্রেমের যে অমর্ত্য রূপে এ-কবিতায় ধরা পড়ে, তা ‘সাবিত্রী’র কবিকে চিনিয়ে দেয়।
‘সাগর, রাত্রি এলে’ শিরোনামের এমন অনুবাদ কাব্যিক আবহ আনে। half-visible = অনতিমূর্ত, half-hushed = অর্ধোস্ফুট, creeps = জানু দিয়ে চলে, sibilation of the waves = কল্লোলদের রণন স্বনন, flecked with quivering spots of foam = সঞ্চারে দেখি স্পন্দফেনার ডোরাকাটা দাগ ইত্যাদি যে সামুদ্রিক আবহ নির্মাণ করেছে, তা যুগপৎ চিত্রল ও ধ্বনিময়। সমুদ্রের ছবি এঁকে কবি পরিবর্তমান জগতের কথা বলতে চান।
‘সন্ধ্যা’ কবিতায় সন্ধে নামার ছবিটি রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্র’-এ লাল চেলি পড়া বধূরূপী সন্ধ্যার থেকে আলাদা। তাই স্বর্ণিল সন্ধ্যা, ভাবুক সূর্য কিংবা (green companion) হরিৎ সঙ্গিনী এক ঈশ্বরীয় আবহ নির্মাণ করে। প্রকৃতি এখানে ঈশ্বরের স্তবগানের পটভূমি। Like rich old age = প্রত্ন, ঋদ্ধ সময়ের মতো – এই শেষ ছত্রটির উপমা সমগ্র কবিতাটিকে অতীত ভারতীয় ঐতিহ্যের উঁচু তারে বেঁধে দিতে চায়।
‘উন্মোচন’ আসলে আত্ম-উন্মোচন। কবিতাটি মূলের মতোই ছন্দের স্পন্দনমুখর। বাংলায় দলবৃত্ত ছন্দ-ই মূলত ব্যবহৃত এখানে। তাই ‘Just a cheek of frightened rose / That with a sudden beauty glows.’ = ‘ভয় পাওয়া এক গোলাপের গাল যেমনতর / আচম্বিতে রূপের আভায় থরোথরো’ কিংবা ‘as a thought / Escapes the mind ere it is caught.’ = কিংবা যেন এক বিবাগী / চিন্তা উধাও মনকে ধরা দেবার আগেই’ চমৎকার লাগে পড়তে। ‘বিবাগী চিন্তা’ এক উদাসীন মনের ছবি এঁকে দেয়। আর কবিতার শেষে heavenly rout / veil ran out = ভিনদেশি তো / নিঃশেষিত – এই আকস্মিক মিলটিও ভালো লাগে।
‘ঋতুচক্র’ কবিতায় determined only by her eyes =‘নয়নের নিয়ন্ত্রণ’ yearlong winter =‘সারাবছরের পুঞ্জিত শীত’ অনুবাদকের নিজস্ব নির্বাচন ও সংযোজন। শেষ দুই ছত্রে ‘আমি তো দেখেছি সারা বছরের পুঞ্জিত শীত / বসন্ত এল তারই আনমনা হাসির ফলে’ শেলির বিখ্যাত পঙ্ক্তিটিকে (if winter comes, can spring be far behind) মনে করায়। একইভাবে ‘ঈশ্বর’ কবিতায় servant of love হয়ে যায় প্রেমের গোলাম এবং clod থেকে আসে মৃৎপিণ্ডপরিসর, যা আসলে ঈশ্বরের সঙ্গে অন্ত্যমিলের সুবিধে করে দেয়।
(চার)
তুলনামূলক অনুবাদবীক্ষণে অগ্রসর হলে মূল কবিতার একাধিক ভাষান্তর আমাদের আলোচনার সহায়ক হয়ে ওঠে। ‘A Tree’ এবং ‘Life and Death’ কবিতা দুটির ক্ষেত্রে কবি-অধ্যাপক তরুণ মুখোপাধ্যায়ের অনূদিত পাঠ তুলনাসূত্রে বিচার্য হতে পারে, যা পত্রিকায় প্রকাশিত ও তাঁর প্রকাশিতব্য ‘কবি অরবিন্দ’ বইয়ের অংশ। [এর বাইরেও তরুণ অনুবাদ করেছেন Bride of the fire (আগুনের বধূ), Krishna (কৃষ্ণ), Saraswati with the Lotus (পদ্মাসীনা সরস্বতী) এবং সনেট Divine Sense (দিব্যানুভব) এই কবিতাগুলি, যা মূলনাগুত হয়েও সৃজনশীল তরজমা। ]
A Tree Sri Aurobindo |
A tree beside the sandy river-beach Holds up its topmost boughs Like fingers towards the skies they cannot reach, Earth-bound, heaven-amorous.
This is the soul of man. Body and brain Hungry for earth our heavenly flight detain. |
অলোকরঞ্জনের অনুবাদ (একটি গাছ) |
নদীর বালুতটের কাছে বৃক্ষটি তো তুলে ধরেছে উপর ডালপালাকে আকাশমুখী আঙুলগুলি অনুপনীত, মর্ত্যে বাঁধা, স্বর্গসংরাগে। এই তাহলে মানবাত্মা : মাটির খিদেয় শরীর, মগজ স্বর্গ-উড়াল ঠেকিয়ে দেয়। |
তরুণের অনুবাদ (একটি গাছ) |
বালুকাময় নদীতীরে একলা সেই গাছ সুদূর সীমা ছুঁতে মেলেছে তার শাখা – আঙুলগুলি যেন আকাশ ধরতে চায় মাটিতে গাঁথা সে যে, স্বর্গপ্রণয় মাখা।
এ যেন মানবাত্মা প্রতিরূপ; দেহ এবং মেধা লোলুপ মর্ত্য প্রতি; অমর্ত্য পথে বাধা। |
অনূদিত দুটি কবিতাতেই অরবিন্দের ‘একটি গাছ’ কবিতার মধ্যে যে প্রতীকী ছবিটি রয়েছে তথা মর্ত্যের আকাঙ্ক্ষা অমর্ত্যলোকের জন্য, তা শেষাবধি মাটি-পৃথিবীর মানবজন্মকেই সার্থক মনে করেছে। তবু ওরই মধ্যে heaven-amorous = স্বর্গসংরাগে, heavenly flight= স্বর্গ-উড়াল এবং ‘আকাশমুখী আঙুলগুলি অনুপনীত’ অলোকরঞ্জনের নিজস্ব শৈলীকে তুলে ধরে। তরুণ সেখানে মর্ত্য ও অমর্ত্য শব্দদুটি এনেছেন, তবে অনুবাদ প্রাঞ্জল। দুই অনুবাদেই মূলের মতো ছন্দের দোলা ও অন্ত্যমিল বজায় থেকেছে।
দ্বিতীয় কবিতাটির দিকে এবার তাকানো যাক :
Life and Death Sri Aurobindo |
Life, death – death, life; the words are led for ages Our thought and consciousness and firmly seemed Two opposites; but now long-hidden pages Are opened, liberating truths undreamed. Life only is, or death is life disguised, - Life a short death until by life we are surprised. |
অলোকরঞ্জন (জীবন এবং মৃত্যু) |
জীবন, মরণ – মৃত্যু আর আয়ু; দীর্ঘ যুগধারা বাহিত এ দুটি শব্দ আমাদের চিন্তা ছেয়ে দিত বৈপরীত্যে, আর এখন খুলে গেল লুকোনো পাতারা স্বপ্নেও অকল্পনীয়, সত্যকে যা যা করে উন্মোচিত। জীবন বস্তুত, কিংবা মৃত্যুই জীবন ছদ্মমতি, - জীবন ক্ষণিক মৃত্যু, জীবনটা আমাদের সচকিত না করা অবধি |
তরুণ (জীবন ও মৃত্যু) |
জীবন ও মৃত্যু – মৃত্যু ও জীবন; শব্দদুটি বহমান যুগে যুগে আমাদের চিন্তাস্রোতে, চেতনায় সুদৃঢ় প্রোথিত; দুই বিপরীত, কিন্তু এখন দীর্ঘপাতায় লুকায়িত; এবার মুক্ত, স্বাধীন, সত্য যে স্বপ্নেও অকল্পিত কেবল জীবন কিংবা মৃত্যু, যেন ছদ্মবেশী প্রাণ, জীবন সে ক্ষণিক মরণ, যদি না বিস্ময়ে হই চমকিত। |
এই অনুবাদ যুগলের তুলনায়ন আমাদের দেখিয়ে দেয়, দুজনেই মূলকে আশ্রয় করে কবিতার পুনর্জন্ম দিয়েছেন। তবে অলোকরঞ্জন মূলানুসারী অন্ত্যমিল বজায় রেখেছেন আগাগোড়াই, যা তরুণ সর্বত্র রাখেননি। শব্দের ক্ষেত্রে অলোকরঞ্জনের ‘দীর্ঘ যুগধারা’ ‘জীবন ছন্নমতি’ যেমন অনুসৃজন, তেমনই তরুণের ‘লুকায়িত’, ‘ছদ্মবেশী প্রাণ’ও শ্রুতিসুভগ ভাষান্তর। এ-কবিতায় অরবিন্দ জীবন-মৃত্যুর সম্পর্ক দেখাতে চান, জীবনের দেওয়া চমক তাঁর কাম্য, নইলে বাঁচাটাও বিস্বাদ। যে কবি নিছক জ্ঞান, পদমর্যাদা, খ্যাতি, কীর্তি অপেক্ষা মানুষের অন্তর্লোকের পরিণতি চান, দিব্যজীবন আর অতিমানসের কথা বলেন, তিনি যে জীবন-মৃত্যুকে এভাবেই দেখবেন তাতে সন্দেহ কী?
অনুকথন
শ্রীঅরবিন্দের কবিতা নানা সময়ে বাংলায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর ‘ভবিষ্যতের কবিতা’ অনুবাদ ড. রামেশ্বর শ’কে অনুবাদকের সম্মান এনে দিয়েছিল। কবিজন্মের দেড়শো বছরের এই উদযাপনময় প্রহরে তাঁর কাব্য-কবিতা-নন্দনভাবনা নিয়ে বাংলা ভাষায় আরো চর্চা প্রয়োজন। তাঁর কবিতার অনুবাদবীক্ষণের পাশাপাশি তাঁর অনূদিত সাহিত্যসম্ভারের তুলনামূলক পাঠ আমাদের নতুনতর অর্থের সন্ধান দিতে পারে। অনূদিত কবিতার মতোই অনুবাদতাত্ত্বিক সাহিত্য সমালোচনার নিরিখে কবি শ্রীঅরবিন্দের পাঠ ও বিশ্লেষণ তাই একান্ত জরুরি।।
গ্রন্থঋণ :
Sri Aurobindo, Collected Poems : The Complete Poetical Works, Volume 5, Birth Centenary Library – Popular Edition, Sri Aurobindo Ashram, Pondicherry, 1972
দেবব্রত মজুমদার, সাবিত্রী সত্যবান (মহাভারতে ও শ্রী অরবিন্দের লেখায়) , শ্রীঅরবিন্দ ইন্সটিটিউট, পণ্ডিচেরী, ২০১২
তরুণ মুখোপাধ্যায়, সৌন্দর্যদর্শন : শ্রীঅরবিন্দ ও অবনীন্দ্রনাথ, প্রজ্ঞা বিকাশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০১৬
তরুণ মুখোপাধ্যায় (সংকলন ও সম্পাদনা), হে পূর্ণ তব চরণের কাছে (শ্রীঅরবিন্দকে নিবেদিত কবিতাগুচ্ছ), এভেনেল প্রেস, কলকাতা, ৩১মে ,২০২৪
সন্ধিৎসা (প্রধান সম্পাদক : রমাপ্রসাদ দে), ফেব্রুয়ারি ২০১৬
যামিনীকান্ত সোম, শ্রীঅরবিন্দ, প্রথম আনন্দ সংস্করণ, ২০১৯
Ramkrishna Bhattacharya, Sri Aurobindo as Translator (academia.edu) পিডিএফ
Octavio Paz, Translation : Literature and Letters (Translated by Irene de Corral), Theories of Translation : An Anthology of essays from Dryden to Derrida,1992, Edited by Rainer Schulte and John Biguenet, Chicago, Univeristy of Chicago Press, pg.154.