বুধবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২১
স্মরণঃ কবি নাসের হোসেন-কে প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী-তে শ্রদ্ধাঞ্জলি
গ্যাব্রিয়েল, বলো
গ্যাব্রিয়েল তোমার হাত থেকে উড়ে যাওয়া পাখি আজ কোন
বার্তা দেবে
বৃক্ষের সবুজ থেকে বাগানের সমান্তরাল উড়ে যাবে আজ
নীল সীমানার দিকে
দিক, দিক কাকে বলে গ্যাব্রিয়েল, দশ দিকের মধ্যে কোনো
একটিও কি
পড়ে তার মধ্যে, জানি চশমার ডাঁটি হাত নিয়ে একটু খুলে
পরে নিলে ফের,
কাফের আমি, মনুষ্যভুক্ত নই হয়তো, কোনোদিন ভুল করে
ডাকিনি ঈশ্বরের নাম
গ্যাব্রিয়েল তোমার পাখির জন্য অপেক্ষা করে আছি, সে পাখি
কি সবুজ, পাহাড়ি নীল,
ধূসর, লাল, হলুদ, ঠিক আছে হলুদ পাখি হলুদ পাখি বলেই
না হয় ডাকব, ডেকে ডেকে
গলা থেকে রক্ত উঠলে তখন ঠিক আসবে তো, তুমি পাঠাবে
তো, আমি রুগ্ণ, আমি
অসহায়, তোমার নীল পাখির জন্য অপেক্ষা, সে উড়েছে
উড়ুক, সে গাইছে গাক,
তার নরম পালকে মুখ গুঁজে পড়ে থাকব, দিন মাস বছর
বয়ে যাবে, পাহাড়ের কোটর
থেকে উড়ে যাচ্ছে পাখি সমান্তরাল, নীচে আমি, আমার
কঙ্কাল, সে বড়ো দূরের কথা
এখন তো নয়, এখন তো বেঁচে আছি, গ্যাব্রিয়েল, তোমার
প্রিয় পাখিটিকে উড়িয়ে দাও
পাঠাও আমার কাছে, পাখিটির রামধনু রঙের পালক, কথাও
বলতে পারে ভালো
সমুদ্রের, সীমাহীন সমুদ্রের জলরাশি, ঢেউ, ঢেউ-এর পর
ঢেউ উপেক্ষা করে
সি-সিকনেস না মেনে, ঝড়ঝাপটায় উড়তে পুড়তে আসতে
থাকবে সে, সেই পাখি
তার চঞ্চুর মধু আমি হাত নিয়ে পরীক্ষা করে দেখব
কিমিয়া, দেখব শিল্প
দেখব কীভাবে সে আমাকে বেঁধে রাখতে পারে, গর্জন ভেদ
করে ওঠে সমুদ্র,
সমুদ্রের দিগন্তহীন দিগন্ত, জাহাজের ডেকে বসে ক্রমান্বয়ে মদ
ঢেলে নিতে নিতে
ভাবব কেন এই দিবসযাপন কেন এই রাত্রির ক্ষরণ
দিনাতিপাত খরশান
ছোরার মতো, ছোরার উপর পা রেখে ব্যালান্স, ক্যামেরার
লেন্সে চোখ রেখে
ক্লোজ-শট্ মিড-শট্ লং-শট্, কিছুতেই ফ্রেমের মধ্যে
পাখিটিকে দেখতে পাইনি
বাইনোকুলার নিয়ে বসে আছি, আছি, বসে, বাইনোকুলার
নিয়ে, পাখিটিকে
দেখতে পাইনি, গ্যাব্রিয়েল, প্রতারক, তোমার কাঁধে ঝাঁকুনি
দিয়ে বলি, কেন
ঋতম্ মুখোপাধ্যায়-এর ধারাবাহিক গদ্য : "কবিতার বাতায়ন"
কথাসাহিত্যের পাশাপাশি করোনা অতিমারী সব থেকে বেশি ছায়া ফেলেছে কবিতার বিশ্বে। ছড়া, লিমেরিক এবং কবিতায় কবিরা করোনার বাস্তব ছবি, আশঙ্কা যেমন ব্যক্ত করেছেন, তেমনই প্রতিবাদ, বিদ্রুপ ও প্রত্যাশার অনুভূতিও ধরা পড়েছে সেখানে। স্বল্পপরিচিত থেকে জনপ্রিয় কবি, এঁরা অনেকেই অতিমারীর ছায়াকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। সেই তালিকায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, সুধেন্দু মল্লিকের পাশাপাশি রয়েছেন পবিত্র সরকার, ঊর্মিলা চক্রবর্তী, তরুণ মুখোপাধ্যায়, অংশুমান কর, হিমবন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামলকান্তি মজুমদার, জগন্ময় মজুমদার, শাওন নন্দী, বিপ্লব চক্রবর্তী, সোফিয়ার রহমান, নির্মল ব্রহ্মচারী প্রমুখ একাধিক কবি। অনুষ্টুপ পত্রিকা ২০২০-এর শারদ সংখ্যায় ছড়ার একটি পর্যায়ই রেখেছে ‘করোনা কাব্য’ নাম দিয়ে, সেখানে লিখেছেন অরিন্দম চক্রবর্তী, সৃজন সেন, অনুরাধা রায় প্রমুখ। থিমের পুনরাবৃত্তি কখনো কখনো ক্লান্তিকর হয়তো মনে হয়েছে আমাদের, মৃত্যু আর অসুখ, ভয় কিংবা প্রতিবাদ এসব কবিতার কেন্দ্রে রয়েছে। তবে সমকালকে চিরকালে উত্তীর্ণ করতেই হবে সর্বদা কবির এমন দায় নেই; থাকলে নজরুল লিখতেন না ‘বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই নবী’। ফলে করোনার দিনগুলিতে কবিতার আয়নায় প্রতিফলিত সময়ের ছবিকে উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করার অভিপ্রায় আমাদের নেই। লকডাইন হোক কিংবা আনলকডাউন - এখন করোনা-সাহিত্যের জন্মভূমি ফেসবুক এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া। গত কয়েকমাসে নিজের ফেসবুকের দেওয়ালে প্রাসঙ্গিক বহু লিমেরিকের লেখক শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার, যেমন :
১) করোনা, তুমি কি গর্বিত আছো, নিজের হত্যালীলায় মুগ্ধ?
চিতা ও কবরে ছেয়ে গেল ভূমি, আতঙ্কে কাঁপে বিশ্বসুদ্ধ।
তবে এ খবর দাও তুমি রেখে –
মানুষ নিজেই মেরেছে নিজেকে
বহু বহু বেশি, নানান ছুতোয় বাধিয়ে নানান মাপের যুদ্ধ। (করোনাকে প্রশ্ন)
২) করোনা হল, তো ক্রিমিন্যাল তুমি, অচ্ছুত, অধঃপতিত;
কিছুই তোমার সপক্ষে নেই – ভবিষ্যৎ বা অতীতও।
কোনোখানে ঠাই পাবে না তো আর,
এইখান থেকে ওখানে ‘রেফার’ –
ঠাঁই হবে শেষে শ্মশানে, চিতায়? আর কোনো নেই গতি তো। (কোথায় যাবে?)
৩) মদ নেই তাতে সমস্যা কী গো! পেটে ঢালো স্যানিটাইজার।
কেন মিছে ভাবো – ঈশ্বর আছে, আর কোনো গতি নেই যার।
মৃত্যু-মিছিল এই দেশ দ্যাখে,
মন্দির গড়ে ওঠে একে-একে,
প্রশ্ন করে না, কবে সুচেতনা will get us wiser। (বিকল্প)
৪) পূর্বে ছিল ভান, অভিনয় – প্রতারকের নিখুঁত চিহ্ন;
এখন মুখোশ মান পেয়েছে, আর সে এখন নয়কো ঘৃণ্য।
ঘৃণ্য যে, সে ধন্য হল,
মহানন্দে সেল্ফি তোলো।
মানুষের সে পরিত্রাতা – ধরাধামে অবতীর্ণ। (মুখোশ)
এসব লিমেরিকে তাঁর কৌতুকপ্রিয়তা, সমাজ ও রাজনীতিমনস্কতার স্পষ্ট পরিচয় মেলে, কখনো বা ব্যঙ্গবিদ্ধ হয় সরকারী ব্যবস্থাও। ফেসবুকে- হোয়াটস্যাপ গ্রুপে-ইউটিউবে কবিতায় করোনা নিয়ে অনেকে সরব হয়েছেন। কয়েকটি দৃষ্টান্ত এইরকম :
১) হে ধরিত্রী, হে বসুধা,
তুমি আমাদের ক্ষমা করো।
শব্দকে আমরা আর অসম্মান করব না কোনওদিন
এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
এই হাতে আমরা আর কোনওদিন পাপ করব নাশুধু তুমি আমাদের ফিরিয়ে দাও
অন্ধের স্পর্শের পবিত্রতা। (স্পর্শ / অংশুমান কর)
২) প্রাণে গান নেই, মাস্কে আটক নব-বসুধা
কোভিডের ক্লেশে ক্লাসে নেই দ্যাখো অমল ও সুধা।
ক্যালেণ্ডারে বা আকাশে তবুও শ্রাবণ আসে
প্রেমে-প্রত্যয়ে, অতিমারী-ত্রাসে, সর্বনাশে। (বাইশে শ্রাবণ ২০২০ / হিমবন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়)
৩) আমাদের দেখা হোক মহামারী শেষে,
আমাদের দেখা হোক জিতে ফিরে এসে।
আমাদের দেখা হোক জীবানু ঘুমালে,
আমাদের দেখা হোক সবুজ সকালে (শঙ্খচিল / সায়ন দাস)
৪) ঝরে পড়া বলতে তুমি এতদিন বুঝতে
বৃষ্টি...শিশির...পাতা...পালক... উল্কা...
এখন এরা সবাই ঝরে যাওয়া বলতে মনে করছে মানুষ। (শাওন নন্দী)
ফেসবুক পোস্টে একাধিক প্রবীণ কবির বিভিন্ন কবিতা চোখে পড়ে যেখানে করোনাকালের স্পষ্ট ছায়া পড়েছে। এমন তিনজন কবি হলেন ঊর্মিলা চক্রবর্তী, শ্যামলকান্তি মজুমদার এবং জগন্ময় মজুমদার। ঊর্মিলা চক্রবর্তী (জন্ম- ১৯৪৬) মেধাবী কবি, আটের দশক থেকে তাঁর লেখালেখি শুরু। তাঁর এই পর্বে লেখা কবিতার মধ্যে রয়েছে ‘মহামারী’, ‘কোভিড-১৯’, ‘পরাজয়’, ‘ত্রাণ’, ‘গ্রহের ফের’। প্রথম দুটি কবিতায় নিঃসঙ্গতা ও মৃত্যুর ছায়া আর পরের দুটিতে আম্ফান ঝড়, ত্রাণকে কেন্দ্র করে সমাজমনস্কতার পরিচয় মেলে। কয়েকটি পঙ্ক্তি মন ছুঁয়ে যায় : ‘চারটে দেয়াল আচমকাই জাপটে ধরল। ড্রয়িংরুমের পচাকাঠে / শিকড়বাঁধা অর্কিডের মতো ছটফট করে উঠল জীবন’; ‘ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে হাত নেড়ে চলে যায়, চেনামুখ আজ নয় একটুও চেনা’; ‘ওদের প্রসন্ন প্রত্যাখ্যানে / ঠোক্কর খেয়ে ফিরে এল আমাদের ঠুনকো সহানুভূতি’। কবি প্রশ্ন করেন এই কষে গিঁট বাঁধা চার দেওয়ালের মাঝে, একা দমবন্ধ নিরাপত্তার কানাগলিতেই কি মেলতে হবে ‘মনের ডানা’? আবার কোথাও বা তিনি ঈষৎ আশাবাদী ‘লক্ষকোটি একা মানুষ ভিড় করেছে এ কোন গ্রহের ফের / মুখোশ খুলে প্রেমিক মানুষ শ্বাস নিতে চায় খোলা হাওয়ায় ফের।’ (গ্রহের ফের) সত্যিই করোনা-উত্তর জীবনযাত্রা আমাদের এখনো যে দারুণ অজানা। অন্য দুই কবিরও একাধিক প্রাসঙ্গিক কবিতার সন্ধান মেলে, এখানে দু-টুকরো উদ্ধার করা হলো :
১) প্রণামের আলো মুছে যাচ্ছে উঠোনে
চরাচর রুদ্ধ। বিদ্ধ চাওয়া –
মন্ত্রোচ্চারণের কণ্ঠ
রুদ্ধ করোনায়। (কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে / শ্যামলকান্তি মজুমদার)
২) মাকালতলার পুকুরে মাছের মুখে মাস্ক
রক্ত গড়ায়
প্রাতর্ভ্রমণের পায়ে চটি নেই
সব দিন রোববার। (করোনা-কাল / জগন্ময় মজুমদার)
এই সময়েই প্রকাশ পেয়েছে তরুণ মুখোপাধ্যায়ের এক ফর্মার কাব্যপুস্তিকা ‘ভাইরাস’ (প্রজ্ঞা বিকাশ, ২০২০)। এ-গ্রন্থেও ছড়া, কবিতা ও প্যরোডিতে করোনাকালীন সময়কে ধরা হয়েছে এবং সেগুলি বিষাদ ও কৌতুকের যুগলবেণী রচনা করেছে। চারটি নমুনা :
১) কাঁটা ভরা অঙ্গ
আরে, একি রঙ্গ!
বলে, দেখি ধরো না –
আমি ভূত করোনা! (করোনা ভূত)
২) ব্যধিক্লান্ত এ-পৃথিবী জীবাণু-জর্জর,
‘অন্ন চাই, প্রাণ চাই’, চাই মনোবল –
শোনাও শোনাও কবি আশ্বাসের গান। (বৈশাখী সনেট)
৩) ঘরবন্দী, বাঘবন্দী খেলছি একা একা –
স্বজন-সুজন যাকেই ডাকি, পাই না কারো দেখা।
হাত বাড়ালেও বন্ধু নয়,
আঙুল ছুঁতেও সন্দ হয়;
খাতার পাতায় দিনরাত্রি খেলছি লেখা-লেখা। (লিমেরিক)
৪) কোন্ উহানের দেশে এলে হেথা ভেসে
কোন্ মারণের সুরে বাজাও মরণবীণা?
হে করোনা।। (‘হে নবীনা’ রবীন্দ্রগানের প্যারোডি)
এই তালিকায় বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে তিন কবির সৃজনে ‘করোনাকালের কবিতা’ (ইচ্ছেনদী, ২০২০)। বিপ্লব চক্রবর্তী, গৌরাঙ্গ দাস, সোফিয়ার রহমানের কলমে ‘অবরুদ্ধ সময়ের বোধের সঙ্গে আমাদের সৃজনশীলতা’ সাযুজ্য খুঁজে পাবে, এই তাঁদের মনোবাসনা। তাঁদের কবিতার মূল সুর যদিও মৃত্যু, তবুও সেখানে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সমানুভব, বিষণ্ণতার সুর, রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়ে বিদ্রুপ ফুটে ওঠে। যেমন, বিপ্লব লেখেন :
যত দায় যেন পরিযায়ীদের যারা উৎপাদনেতে যুক্ত
ছিন্নশরীর রেলের লাইনে পড়ে আছে রক্তাক্ত
ইতিহাসে চোখ বারবার দেখি মৃত্যুকে নিয়ে রাজনীতি
সঙ্গে দোসর ঘণ্টাখানেক দিকে দিকে চলে দুর্নীতি।
এভাবেই আছি কোনোমতে বেঁচে সকলের দিকে চেয়ে
কাটুক হতাশা সকাল আসুক করোনা বিনাশী হয়ে।। (২২শে মার্চ ২০২০)
করোনাকালের কবিতাতে প্রাত্যহিক যাপনের ছবি জেগে ওঠে, তাই গৌরাঙ্গ দাস লিখতে পারেন : ‘ধুলোতে বৃষ্টির ফোঁটার দাগ, নাকি / স্যানিটাইজ করা হয়েছে এবেলা?’ (করোনাকালের কবিতা : ২৪)। কখনো বা দেখেন ‘মাটির মানুষ / অতিথি নয়, পরিযায়ী / মাইলের পর, মাইল...’। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ব্যাধির বিষ এখন সকলের শরীরে, আর তাই ‘বুকে মাথা রাখবার, হাতে হাত রাখবার / যত কষ্টই হোক – দূরে থাকাই নিয়ম’। দূরত্ব বিধিতে
কাকেদের আড্ডা কিংবা বসন্তের কোকিলও আসে না আঙিনায়। আবার সোফিয়ার রহমান দেখেন এক মুখোশদুনিয়ার চিত্র ‘আমি আর আমার ছায়ার মধ্যে রয়েছে মুখোশ’। এই দুর্দিনের কালে স্কুল-কলেজের একাকিত্ব তাঁকে স্পর্শ করে, বলেন ‘কেউ আসবে না এখন এই নষ্ট যুগের বিস্মৃতির কালে’। খাবার সন্ধানী মানুষদের অসহায়তা তাঁর সামনে তুলে ধরে একটা ভাঙাজীবনের ছবি। মুখে মাস্ক আর বুক পকেটে স্যানিটাইজার নিয়ে মানুষ খুঁজতে চায় তাঁর দুই চোখ, পান না। করোনাকালে কথা বলেন মৃত বন্ধুদের সঙ্গে, বোঝেন মৃত্যুই সবথেকে নিরাপদ আশ্রয়। জনে জনে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স বিলিয়ে এই ভালো থাকা তাঁর কাছে সুখময় নয়, কারণ ভারতের মতো দেশে নিজেকে অভাবী ও নিরন্ন ভাবা অন্যায়। তাঁর বিদ্রুপ : ‘লকডাউন হলেই / রেল লাইন ধরে হাঁটার বিজ্ঞাপন দেব’। যদিও তাঁর কবিতার মূল সুরে বাজে এক বিষাদবেদনা, প্রেমের কবিতার নামও তাই হয়ে যায় ‘সোস্যাল ডিস্টেন্স’ :
সোস্যাল ডিস্টেন্সের কাছে বসে আছি
সকাল হয়ে যায়, বিকেল যায়
রাতও আস্তে আস্তে চলে যায়।
ভেসে আসে শান্ত হাসি মুখ
ভেসে আসে আলিঙ্গন সুখ
স্পর্শে বিষ মিশে আছে হে প্রিয়া
এখন সময় যে বড্ড থমকে
জীবন যায় দ্রুত
নির্মল ব্রহ্মচারী তাঁর ‘করোনা ও দাবাই’ (আন্তর্জাতিক প্রকাশন, ২০২০) ছড়া ও কবিতা সংকলনে করোনাকালীন ভারতের ছবি যেমন আঁকেন, তেমনি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন সরকার ও অতিরিক্ত রাম-ভক্তির প্রতি তাঁর ক্ষোভও ব্যক্ত করেন। ছড়া হিসেবে তাঁর রচনাগুলি তেমন উন্নতমানের না হলেও নরওয়ে-প্রবাসী কবির লেখায় সাংবাদিক সুলভ দক্ষতা আছে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত এইরকম :
১) করোনার ভাইরাস
থাকবে না চিরকাল
তাড়াবোই, নাই ত্রাস –
করি নাশ ভাইরাস। (করোনা ও পরজীবী)
২) ঢোল, থালি, ঘণ্টা
বাজা রে জন্তা,
ভেগে যাবে রোগ
খিদে – দুর্ভোগ
বাঁচে জীবনটা – (করোনার ছড়া)
৩) খুব কাছে খুব দূরে – সীমানা পেরিয়ে বহুদূর... দূর
‘কোন আইনে রেল লাইনে পড়ে কাটা,
ভুখানাঙ্গা হতভাগা দীন-মজদুর!’ (রেললাইনে হতভাগা)
৪) পথে ঘাটে মাঠে হায়
মুমূর্ষু অসহায়,
করোনায় শেষটায়
গরিবের আজীবনই দুখের পালা! (দুখের পালা)
আবার MIT এর ওয়েবসাইটে ‘কনটেইমেন্ট’, ‘অ্যালাইভ’, ‘থিংস টু ডু ইন কোয়ারেন্টাইন’ ইত্যাদি নাম দিয়ে লেখা হয় ছাত্র-ছাত্রীদের কলমে ইংরেজি কবিতাও। যেমন, Maish M Prome-এর একটি কবিতা : ‘Still can’t go to outside but we can go to the rooftop / To look at the sky and remember that it’s good to be alive / All those years when the city was alive’। করোনাকাল-কে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে একাধিক প্যারোডি, মধুসূদন থেকে জয় গোস্বামী কেউই প্রায় বাদ পড়েননি :
১) হে বঙ্গভূমিতে এলো করোনা এমন,
তা সবে অবোধ তুমি অবহেলা করি,
প্রমোদে হইয়া মত্ত করিলে ভ্রমণ –
পরদেশ হইতে আনি জীবাণু ইহারি,
কাটাইলে কতদিন গৃহ পরিহারি,
অবাধ্য চঞ্চল অতি দেখি তব মন।
২) অদ্ভুত ভাইরাস এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ
যারা ল্যাদখোর সবচেয়ে বেশি আজ হাত ধোয় তারা;
৩) আমি ডাক্তার রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত
যবে কোনো মানুষের লালারস থেকে
ভাইরাস আর মিলিবে না
করোনার এই মহা আতঙ্ক পৃথিবীতে আর থাকিবে না।
৪) দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে সব,
মাঝে শুনি কিসের কলরব,
স্যানিটাইজার স্টকে আছে?
৫) বেণীমাধব, বেণীমাধব তোমার বাড়ি থাকো,
বেণীমাধব এই অবস্থায় প্লিজ বেরিও নাকো।
৬) কেউ লকডাউন তোলেনি, তেতাল্লিশ দিন কাটলো
কেউ লক ডাউন তোলে না।
এগুলি হোয়াটস্যাপ-ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে আমাদের চিত্ত বিনোদন করেছে, এসব প্যারোডির লেখক অজ্ঞাত। আবার এই সময়েই দেখা গেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গান লিখেছেন, গণমাধ্যমে সে গান গেয়েছেন গায়ক-মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন : ‘স্তব্ধ করো, জব্দ করো / করোনাকে ভয় পেয়ো না / ভিড় থেকে সব্বাই দূরে থাকো / করোনাকে ছুঁতে দেব না... / সবাই মিলে বাঁচতে হবে / বাংলা কখনো হারে না।’ এ-গানের লিরিক যদিও সতর্কতা-সঞ্চারী ও উদ্দেশ্যমূলক। আবার তাঁরই লেখা কবীর সুমনের কণ্ঠে ‘ঝড় থেমে যাবে একদিন / পারলে সেদিন খুঁজে নিও’ গানে অনেকে আশাবাদ দেখেছেন। এসবই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে।
৩.
করোনা কেড়ে নিয়েছে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের অনেক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে। সকলেই যে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন, এমন নয়। কিন্তু এই অন্ধকার সময়ে তাঁদের মৃত্যুর পিছনে করোনা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী। এই তালিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বা শঙ্খ ঘোষের মতোই যুক্ত হতে পারে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের নাম। অসুস্থ অলোকরঞ্জনকে জার্মানির হাসপাতালে না পাঠিয়ে বাড়িতে চিকিৎসা করাতে হয় করোনার কথা মনে রেখেই, সেখানেই তিনি মারা যান ১৭ নভেম্বর ২০২০। তাঁর শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘বাস্তুহারার পাহাড়তলি’ (অভিযান, ২০২০) তে একটি কবিতা পড়ে চমকে উঠেছিলাম, তাঁর জীবৎকালেই ফেসবুকে পোস্ট করি সেটি। কবিতাটির নাম ‘থিম’ :
যোজন জুড়ে প্রাতরাশ
মেহগনির টেবিল
রুটিতে মাখা পনির
কবি তবুও মহামারীর
থিমটা নিয়েই লিখছে
ভীষণ প্রাসঙ্গিক এবং শ্লেষবিদ্ধ এ-কবিতা যখন লেখা হয়, তখনই অতিমারী বিশ্বজুড়ে ভয়াল রূপ নিয়ে দেখা দেয়নি। কবিরা এমনই ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হন। পরবর্তীকালে অলোকরঞ্জন রেডিওতে (১২ এপ্রিল, ২০২০) এই করোনা অতিমারী নিয়ে একটি ভাষণ দেন, সেখানে পাওয়া যায় একটি কবিতা, যা অলোকরঞ্জনীয় বৈদগ্ধ্যে উজ্জ্বল :
করোনা থেকে একটুখানি বাঁচার অভিলাষে
বাজার থেকে শ্বাস মুখোশ ফুরিয়ে গেল যেই,
আমি তখন বার্টোল্ড ব্রেশটের কাছ থেকে তাঁর টুপিটা নিলাম সহজেই,
টুপি তো নয় শিরস্ত্রাণ
তার নাসারন্ধ্র খোলাই থাকে
মরতে হবে জেনেও চালিয়ে যাই
ধনতন্ত্রের তৈরি করা ভাইরাসের বিরুদ্ধে
আমার বিজন পাক বুনুনির এপিক থিয়েটার। (বৈতালিক পত্রিকায় ২০২০ সালে প্রকাশিত)
করোনা অতিমারীকে একধরণের বিশ্ব-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করেছেন অনেকেই, তারই সমর্থন আছে এখানে। ব্রেশট-কে টেনে এনে অলোকরঞ্জন এখানে তাঁর প্রতিবাদী মার্ক্সীয় চেতনার স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে এরই পাশে পঞ্চাশের আরেক মৃদুকণ্ঠ আস্তিক কবির চোখে করোনা ‘ব্যাধ’ রূপে চিহ্নিত হয়। তিনিও এর পিছনে ‘ক্রূর প্রতারণা’র আভাস পান। শারদীয়া কবিসম্মেলনে (২০২০) প্রকাশিত এ-কবিতায় করোনাকালের ছায়া উজ্জ্বল; মুখোশ, সামাজিক দূরত্ব কবিতার মধ্যে এসেছে। যদিও শেষাবধি হার্দ্য আস্তিক্যের সুর একে আমাদের স্মৃতিধার্য করে :
আমি বাকহীন মুখোশ এঁটে অভিভূত
যেন গ্রহযাত্রীর উদ্বেল শরীর।
রুদ্ধমুখ ফেটে পড়ে
কথা বলতে চাইছে
লৌহকপাটে অধীর ধাক্কায়।
হাতে আমার দস্তানা, অস্পৃশ্য শত্রুর ছোঁয়া
লাগে পাছে। তবু
ভিতরে নগ্ন তৃষিত হাত তোমার পরশ ভিখারি –
অভয়ের ব্যাকুল প্রার্থনায়।
মুক্ত হোক দেশ
মুক্ত হোক মানুষ
খুলে দাও এই দুঃস্বপ্নের শিকল
উন্মোচিত কর ক্রূর প্রতারণা। জানি,
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ব্যাধি আর
অমোঘ ব্যাধ। বিশ্বের অমর হৃদয়ে গুঞ্জরিত
বিশ্বাস আর ভালোবাসার কমল ভ্রমর। (ব্যাধ, সুধেন্দু মল্লিক)
মৃত্যুভয় আর অনিশ্চয়ের দোলা বুকে নিয়ে আমরা ব্রেশ্টের মতো অন্ধকার দিনের গান গাই। জীবনানন্দের মতো ভাবি ‘শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়’। করোনাকালের এসব কবিতাও মৃত্যুভয় বুকে নিয়েও মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছে।।