রবিবার, ১ আগস্ট, ২০২১

মেঘ অদিতি-র ঝুরোগল্প


মানুষের মুখ

শীতের ক্ষণস্থায়ী বিকেল তখন সন্ধ্যার সাথে জায়গাবদল করছে। কিছু দূরে নীলরঙা পাহাড়। সন্ধের ম্লান আলোয় তারা দ্রুত ঝাপসা হতে চাইছে। শীতের এক ঝকঝকে দিনের শেষবেলায় সেখানেই ওদের দেখা হয়ে গেল। ওরা মানে দুটি গান যাদেরকে শুনতে প্রায় একইরকম। একথা জানবার পর থেকেই প্রথম দ্বিতীয়কে অনেকদিন ধরে অনুসন্ধান করছে। ওরা হাঁটছে সমুদ্রতীর ধরে। সরুচোখে দ্বিতীয়কে অনেকক্ষণ ধরে দেখে প্রথম। দেখতে দেখতে ঘাড় ফিরিয়ে দ্বিতীয়কে বলল, শেষ অবধি দেখা হলো তাহলে! বলেই কর্তৃত্বের সুরে বলল, এসো, এগোনো যাক। 

দ্বিতীয় মৃদু হাসে। হাওয়ায় ওর চুল এলোমেলো। নোনা হাওয়ার দখলদারির হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে দ্বিতীয়। পা ফেলছে এলোমেলো। পোশাক আলুথালু। প্রথম লক্ষ্য করল, দ্বিতীয়কে সে নিজের মতই যতটা গোছানো ভেবেছিল আসলে সে ততটা নয়। ভ্রূ কুঁচকে ঘুরে দাঁড়ায় সে। সরাসরি দ্বিতীয়র উদ্দেশ্যে বলে, তোমাকে সবাই আমার কপি বলে কেন

সমুদ্রের ঢেউগুলো পরপর আছড়ে পড়ে। আবার তারা ফিরেও যায়। সাংঘর্ষিক এক প্রশ্ন যা ঢেউ আছড়ে পড়ার মতই। অথচ দ্বিতীয়র হেলদোল নেই। সে কেবল ঢেউয়ের ওঠানামা দেখে। তারপর ফের এলোমেলো পা ফেলে। প্রথম এক জায়গাতেই দাঁড়িয়ে। উত্তর কর, কেন তোমাকে আমার মত দেখতে?

এবার মৃদু হাসে দ্বিতীয়। গুনগুন করে, কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন দিয়ে যাও.. 

-    এটা প্রশ্নের উত্তর নয়!

-    কেন? আপনি আমাকে তুমি করে কেন বলছেন?

-    যদি বলি আমি সে, যার রাগ আর সুর নিয়ে তুমি তৈরি

-    ওহ বুঝেছি, কেন আমায় তুমি বলছেন। আপনি আগে জন্মেছেন। আমি কিছুটা পরে। আমরা একই রকম এরকম মনে হচ্ছে আপনার। কিন্তু কেন?

-    আমার একার প্রশ্ন নয়। কথা যারা গান শোনে তাদেরও।

-    একটা প্রশ্ন।সময় গতি অনাপেক্ষিক; মানে বলতে চাইছি সময় অপরিবর্তনীয়তাহলে আপনি আগে জন্মালেন কী করে!

-    বাহ! কথা ঘোরাচ্ছো! তুমি আমার শরীরকে ভিত বানিয়ে ঘরবাড়ি বানাওনি?

-    যদি বানাইও, অসুবিধে? এমন কত তো হয়েছে! স্বয়ং ..

-    থামো! উদাহরণ দেবে না। আমার কথাগুলোও তো উল্টেপাল্টে তোমারই শরীরে ভীড় করে আছে। কী ব্যাখ্যা তার?

-    যা আমরা নিজের বলে ভাবি সেসব কি সত্যি হয় সবসময়? নাকি সমস্তই আপেক্ষিকতা? সত্তাটুকুই আসল। যা আপনারও আছে। আমারও। তাহলে?

যুক্তি শুনে প্রথমের খুব রাগ হল প্রথমে। পরক্ষণেই ভাবনার দিকবদল হল। বদলে যাওয়া পৃথিবী তো সুরহীন। একাকিত্বের। এই পৃথিবী অচেনাও। অন্তহীন যন্ত্রণার এসময়ে অন্তত একটা গান যদি আমার মত হয়, হোক না.. 

ভাবতে ভাবতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে প্রথম। তারপর বালিতে আঙৃল বুলিয়ে কিছু একটা আঁকতে চেষ্টা করে। সমুদ্র এখন খুব শান্ত। 

অল্প দূরের অন্ধকারে দ্বিতীয়ও বসে। সে একটা ঝিনুক কুড়িয়ে পেয়েছে। আপনমনে তাই দিয়ে ছবি আঁকছে। 

আশ্চর্য এই, হুবুহু তারা একই ছবি আঁকছে। বিষণ্ণ মানুষের মুখ….

1 টি মন্তব্য: