বৈতরণী
গাড়ুখানা পাথরের উপর রেখে ধুতি তোলে দীনদয়াল। বসে পড়ে ঝোপের আড়ালে। কানের উপর পৈতেটা তুলতে ভোলে না। গম ক্ষেতের হুই পারে একটা মাথা ওঠে। সারা হল তার। ও ছগন, নিচু জাত৷ মাঠের মজদুরি ফেলে গিয়েছিল শহরে। লকডাউনে ফিরেছে ব্যাটা বছর খানেক। ফিরতেই হত। দুদিনের ঝকমকি বৈ তো নয়! বাঁহাতে গাড়ু, ডান হাতে দাঁতন, ছগন ঘাটের দিকে এগুচ্ছে। আগের দিনকাল হলে, অর্ধ উলঙ্গ বামুনকেও পেন্নাম ঠুকে যেত। আজকাল সে'সব রীত নেই। দীনদয়াল গম্ভীর হয়। মুখ দিয়ে যে শব্দটি বেরোয়, তা উদরে চাপ দেওয়ার কৌশল জনিত, নাকি হতাশা জনিত, বোঝা দায়।
গম ক্ষেতের সোনালিতে ঈষৎ লাল আভা। নদীতেও লছমিয়ার সিঁদুরের ছিটে। মেয়েদের সকালের কাজের জায়গা আলাদা। শুদ্ধাচারী লছমি এতক্ষণে ফিরে গেছে ঘরে। কাপড় ছেড়ে উনুন ধরিয়েছে নির্ঘাৎ। রামলালার ভোগ তৈরি হবে৷ অতিমারীর কালে আয় কমেছে। পুজো-আচ্চা কম। নিজের সংস্থান নাই, লোকে ঈশ্বরকে খোরাক জোগায় কোত্থেকে? ভীতি শ্রদ্ধা বাড়ায়। কিন্তু কলিকালে তা দিয়ে নৈবেদ্য জোটে না। দীনদয়ালের তবু আছে এক বিঘে। জমিনদার যজমান সেবাইত বাপকে যেটুকু দিয়েছিলেন। তার, লছমির আর রামলালার কোনমতে গুজরান হয়ে যায়। রামালালার ভোগে তেল মশলার বালাই নেই। অভিযোগও নেই। মানুষের কড়াইয়ে ওসবের অভাব দেখা দিলে জিভে চড়া পড়ে৷
সূর্য এবার এক লাফে উঠেছে নদীর মাথায়। চিক চিক করছে ঢেউদের মাথা। ছগনের কি শৌচ সারা হল? দীনদয়াল উঠে পড়েছে ধুতি ঝেড়ে৷ ছোটলোকটা উঠে এলেই..উঠে আসছে কি সে? একসঙ্গে জলে নামা…
ছগন অথচ উঠে আসে না৷ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে দূরের পানে। দীনদয়াল আরও এগোয় ঘাটের দিকে৷ গলা খাঁকারি দেয়। ছগন খেয়াল করে না৷ সম্ভ্রমের অভাব দীনদয়ালকে পীড়া দেয়। পায়ে পায়ে দীনদয়াল নামে সিঁড়ি দিয়ে। ছোটলোকের ছোটলোকামিতে রামলালার নিবেদনে দেরি না হয় আজ!
ছগনের কর্ণকুহর বন্ধপ্রায়। চক্ষু বিস্ফারিত। যা বিড়বিড় করে, তা রাম নাম মনে হয়। দীনদয়াল ছগনের দৃষ্টি অনুসরণ করে। কী ভেসে আসে? এক, দুই, তিন, চার...সার বেঁধে...
মানুষ বা মানুষের মতো। দেহ বা দেহর মতো। ফুলে ফেঁপে গোলগাল। আসছে তো আসছেই। কেউ আবার আটকে যাচ্ছে দূরের তীরে, পাথরে, খাঁজেখোঁজে। মিছিল করে বৈতরণী পার হচ্ছে। বৈতরণীতে কভু এত ভিড় ছিল?
ছগন আর্তনাদ করে ওঠে। যতদূর চোখ যায়, দূরের তীরগুলোতে চিল শকুনের অবতরণ দেখতে পায় দীনদয়াল৷ তারপর এই তীরে প্রথম দেহটি এসে ঠ্যাকে৷
*******
এ গাঁয়ে প্রাতঃকৃত্যের সময় আরও খানিক এগিয়েছে এখন৷ রাত থাকতেই মেয়ে বউ-রা গাড়ু হাতে মাঠে নেমে যায়৷ সকালে আসে ভিনদেশী ক্যামেরা, সাংবাদিক, মাইক। আসেন ডিএম সাব, প্রায়ই। কাদের মড়া, ইউপির না বিহারের, তা নিয়ে তরজা হয় টিভিতে। পুরুষমানুষরা বাইট দেওয়ার জন্য তৈরি। ওরা ছগন আর দীনদয়ালকেই খোঁজে বেশি। তারাই প্রথম দেখেছিল।
ছগন খুশ। টিভিতে মুখ দেখিয়ে নয়, কাজ পেয়ে। মড়া টানতে সরকারি লোকদের সাহায্য করে সে। পিপিই দেবে বলেছিল৷ দেয় নাই এখনও। কোমরে দড়ি বেঁধে অচেনা মানুষ বা মানুষের মতোদের বৈতরণী পার করিয়ে দেয় সে।
দীনদয়াল ভি খুশ। যজ্ঞ হবে অনেকদিন পর। লাশ ভেসে এল গাঁয়ের ঘাটে। অপবিত্র হল সব, রাম রাম! মোড়লরা বিহ্বল মুখে মেনে নিচ্ছিল যখন দীনদয়ালের কথা, তখন পুরোনো প্রতিপত্তি ফিরে পাওয়ার একটা বোধ জন্মাচ্ছিল।
রাত হলে দিনদয়াল বৈতরণীর স্বপ্ন দেখে। জীবন আর মৃত্যুর মাঝে যে নদী। পাড়ে স্তূপাকার অস্থিসজ্জা। শোণিতবর্ণ স্রোত। লাশেরা ভেসে চলে। দীনদয়াল যে কোনো লাশের মুখের চাদর সরিয়ে দেয়।
নিজের মুখ দ্যাখে৷
অসাধারণ লাগলো। খুব প্রাসঙ্গিক বিষয়ে সুন্দর বিন্যাস।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ লাগলো.... প্রাসঙ্গিক.... বাস্তব!
উত্তরমুছুনVery poignant
উত্তরমুছুনVery poignant
উত্তরমুছুন